স্লেট-রঙা আকাশটা নিচে ঝুঁকে পড়ে একসময়। দুপুরটা বৃষ্টি হয়ে যায়। সামনেটা ধোঁয়াটে, আবছা। নিমের ছোট ছোট সাদা ফুল বনজ সুঘ্রাণ ছড়িয়ে শরীর বিছিয়ে মাটিতে। বন-তুলসীর ঘন ঝোপের মধ্যে ডানা গুটিয়েছে একটা শালিক, হলদেটে একটা ফড়িং সেদিকে যেতে গিয়েও থমকে যায়। স্বচ্ছ পাখায় কয়েক বিন্দু জল। পদ্মপাতা’র দৃষ্টিবিভ্রম। ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর।

পুরোনো বাড়িতে, ছোটবেলার জানালায় ছিল মোটা মোটা লোহার শিক। কেউ কেউ বলতো, জেলখানা যেন। এইরকম কোন কোন বৃষ্টি-ধোয়া দুপুরে, জানালার ঠিক পাশের পুকুর থেকে দ্রুত ছুটে আসতো রাশি রাশি জলকণা। লোহা আর জলের গন্ধ মিশে একটা মিশ্র ধাতব গন্ধের সৃষ্টি হত। জেলখানা নয়, সে জানালা আমার খোলা আকাশ, কল্পনার ক্যালাইডোস্কোপ। রাতেরবেলা কালো জলের শিরশিরে ডাক, মৎসকন্যা না উঠুক, হিল্ হিল্ করে সাপ সরে সরে যেত, ঘাস ছেড়ে ঘন কালো জলে। পুকুরপাড়ে নিস্তব্ধতা, অন্ধকার ঘরে খোলা জানালা– সেইসব ঘুমহীন কল্পজাল বোনার রাতে, চুপি চুপি কথা হতো নিজের সঙ্গে। ওই জানালার ধারে বসেই ঠাকুমা একদিন বলেছিল, “ও মণি, তুমি কি আমারে খারাপ বাসো?” ভাল তো সবাই বাসে, খারাপ বোধহয় একমাত্র বরিশালের মানুষরাই বাসতে পারে! সেই তারা-হয়ে-যাওয়া বুড়িকে বলতাম– না না, আমি কারুক্কে খারাপ বাসি না, অত সময় কই এক জীবনে।

কিন্তু ভাল-ই বা বাসি কি? কী জানি, বুঝি না। কিন্তু ওই যে ছোট্ট ছোট্ট দু’টো ফ্যাকাশে গোলাপি বনফুল ফুটেছে ভয়ে ভয়ে টবের কোণায়, আঁজলা করে জল দিই ওদের। সবুজ গঙ্গাফড়িং আসতো একটা সকালে, সেটা আর আসেনা বলে অযথা বিচলিত হই। শুকনো ফুল কুড়িয়ে নিয়ে মাটির ভাঁড়ে রাখি। তবে কি ফুরিয়ে না গেলে, মিলিয়ে না গেলে, ভালবাসা বোঝা যায় না? দুপুরটা যেমন বৃষ্টি হয়ে যায়, উথলে ওঠে, ভালবাসাও জীবন পাক। আমি থাকি বা না থাকি, আমি যে ছিলাম, সেই রেশটুকু যেন থাকে।



তিনটে বিশালদেহী নারকেলগাছ আকাশের অনেকটা কিনে নিয়েছে। সূর্যটা প্রতিদিন ওদের পাতার আড়ালেই রাতের আশ্রয় নেয়। টুপচুপ অন্ধকার অজস্র পালকের মত ধীরে ধীরে নেমে আসে। ভারহীন, শব্দহীন, তবুও ভীষণরকম বাঙ্ময়। অন্ধকারের একটা মাধুর্য আছে; আলোর নির্লজ্জ রঙমাখা শহুরে অন্ধকার নয়, ফণীমনসার কাঁটায়, বটের ঝুরিতে, বুনো কচুর পাতা-ভরা যে অন্ধকার, সে শিরশিরানি জাগিয়ে তোলা সুন্দর। উপরে মেঘের ছাউনি, ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করা দু’একটা অবাধ্য তারা– সেই সৌন্দর্যে আটকা পড়ে যায়।

মেয়েটা রাত্তির ভালবাসে। অন্ধকার ভালবাসে। অন্ধকারের নিজস্ব অস্তিত্ব তার চেনা। হালকাপলকা পশমিনা শালের মত সেই অস্তিত্ব, সব কষ্ট, সব ক্ষত আলতো করে ঢেকে দেয়। ভারি নিশ্চিন্ত লাগে। একজোড়া কালো ডানা গজায়…. হুউউশ করে সময় পেরিয়ে যায়।
গাঢ়তর হয় রাত, জোনাকি জ্বলে আজকাল মাঝে মাঝে। উড়ন্ত সবুজ পান্নার মত মনে হয় লুসিফেরন আর লুসিফেরজের এই কাণ্ডকারখানা। ওরা নাকি সঙ্গী খোঁজে আলো জ্বালিয়ে। হবেও বা। মেয়েটার মনে হয়, এই রাতটা-ই জীবন্ত। বিশ্বচরাচরে কাউকে প্রয়োজন, মনেই হয় না। বেলফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করে হাওয়ায় ভর করে।
রাত হতে ইচ্ছে করে।
গাছ হতে ইচ্ছে করে।
কিছু হয় না।

অনেকক্ষণ পর, নারকেলগাছগুলো আর কালো থাকে না। সবুজ হয়ে ওঠে আবার।আরেকটা দিন,মানুষ সেজে ঘোরার যন্ত্রণাময় আরেকটা দিন শুরু হয়।

ছোটবেলায় পাড়া’র একজন দাদা’র প্রতি আমার ক্রাশ ছিল। দাদাকে বেশ দেখতে, ঝক্‌ঝকে চেহারা, হাল্কা মাস্‌ল ছিল। সব মিলিয়ে, যাকে বলে বেশ নয়নমনোহর 🙂 তো, এই দাদাকে একদিন আমি দৈবাৎ পাড়া’র পুকুরে ল্যাঙট পরে স্নানরত অবস্থায় দেখতে পাই। তারপর, কোথা হইতে কী হইয়া গেল কে জানে, আমার সমস্ত ক্রাশ এক্কেবারে ক্রাশ্‌ড! সবাইকে কী আর জাঙিয়া পরে ঘুরে বেড়ালে ভাল লাগে রে ভাই 😦
আমি কিন্তু সেই ক্রাশ ইয়ে হয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম সেই বয়সে। এই এত বছরে সেই ডিপ্রেশন অবশ্য কাটিয়ে উঠেছি, কিন্তু গতকাল “গুমনামি” দেখতে বসে, “আবার, আবার সেই কামান গর্জন! কাঁপাইয়া ধরাতল, বিদারিয়া রণস্থল” 😥 বড্ড কষ্ট পেলাম ফের। এক দৃশ্য, এক অনুভব। আমি যে অনির্বাণ ভট্টাচার্য’র জাব্‌রা ফ্যান ছিলাম গো! কেন জাঙিয়া-পরা অনির্বাণ, রাতদুপুরে নেতাজীকে বসার ঘরে দেখতে পেয়ে কথা বলতে গেল গো! কেন? মুন্নাভাই গান্ধীজি’র সঙ্গে কথা বলেছে বলে ওকেও নেতাজী’র সঙ্গে বলতে হবে 😦 ইকি!

যাক্‌গে, এসব ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের বলে লাভ কী আর। যা হওয়ার হয়ে গেছে। “গুমনামি” দেখে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছি। আমি অবশ্য থ্রিলার ভেবে দেখতে গেছিলাম। মানে, পোস্টারে সিজিদ্দা সেরকমই লিখেছিলেন। গিয়ে দেখি ডকু-ফিচার ধরণের একটা কিছু ব্যাপার। চন্দ্রচূড় ঘোষ এবং অনুজ ধর– এঁরা দু’জনে ‘Conundrum: Subhas Bose’s Life after Death’ শীর্ষক যে গবেষণামূলক বইটি লিখেছেন, “গুমনামি” মুলতঃ সেটিকেই অনুসরণ করেছে।
সাড়ে-আটশোরও বেশি পৃষ্ঠার বইটি, কতজন পড়েছেন আমি জানিনা। যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা অবশ্যই বুঝবেন, ফিল্ম-এ যে সমস্ত ঘটনা, নথি, চিঠিপত্র এবং প্রমাণ ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট, ফরমোসা’র (এখন তাইপেই) বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী’র মৃত্যুর বিপক্ষে তুলে ধরা হয়েছে, যেভাবে গুমনামি বাবা’র নেতাজী হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, তা প্রায় সমস্তটাই বইতে রয়েছে।

সিনেমায় আমরা পুরো ন্যারেটিভ-ই দেখি সাংবাদিক এবং নেতাজী গবেষক চন্দ্রচূড় ধর-এর (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) চোখ দিয়ে। সে, অফিসে বসে একদিন নতুন একটি অ্যাসাইনমেন্টে পায় এবং তার জন্য পড়াশোনা, রিসার্চ ইত্যাদি করতে গিয়ে চন্দ্রচূড়ের নিজের জীবনযাত্রা ও জীবনবোধ সম্পূর্ণভাবে পালটে যায়। নেতাজীকে নিয়ে গবেষণায় মগ্ন হয়ে সে দাড়ি-টাড়ি পর্যন্ত আর কাটেনা, বৌ রণিতা’র (তনুশ্রী চক্রবর্তী) সঙ্গে শোয়না, এমনকি বৌ শোয়া’র জন্য যখন সিডিউস করতে চায়, তখনও তার নেতাজী’র জাপানি দোভাষীর কথা মনে পড়ে। এসব ঝামেলায়, রণিতা খুব ক্ষেপে গিয়ে একদিন চন্দ্রচূড়কে ডিভোর্স দিয়ে দেয় এবং জানায় যে, সুভাষ ঘরে ফিরেছে কিনা তা সে জানেনা, কিন্তু সুভাষের জন্যই তার আর ঘরে ফেরা হল না। চোখে জল এসে গিয়েছিল! মাইরি বলছি।

তা সে যাইহোক, বৌ চলে যেতেই চন্দ্রচূড় দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে ফেলে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে, ফের গবেষণায় মন দেয়। আগে দাড়ি কাটতে কী অসুবিধে ছিল কে জানে।

তারপর যা যা ঘটনা ঘটে, নেতাজী’র অন্তর্ধান বিষয়ক কন্সপিরেসি থিওরি, তৎকালীন সরকারের কার্যাবলী ইত্যাদি, সেসব সিনেমা দেখলে জানতে পারবেন। ওই বইটা পড়লে, অবশ্য আরো বেশি জানবেন।

আমাদের পিয়ো বুম্বাদা নেতাজী’র ভূমিকায় ক্যামন অভিনয় করেছেন, তা জানতে গেলেও আপনাকে ওই সিনেমা দেখতে হবে। এ হল ওঁর আ-আ-আ-আম্মি চ্চুরি ক্করিনি থেকে উত্তরণের সিনেমা। মেকআপ খুব খারাপ হয়েছে, একথা শত্তুরেও বলবেনা (আমি তো না-ই, আমি সিজিদ্দা’র সব সিনিমা ফার্স্ট ডে সেকেণ্ড বা থার্ড শো দেখি। ভয় করে, চেনাশোনা বন্ধুরা খিস্তি মারে, তবুও যাই), কিন্তু ম্যানারিজম থেকে বুম্বাদা পুরোপুরি বেরোতে পারেননি। গালে সুপুরি নিয়ে কথা বললে যেমন হয়, অমন লেগেছে কিছু জায়গায়। তনুশ্রী যথাযথ। অনির্বাণ কিছু জায়গায় বেশি স্মার্টনেস দেখিয়ে ফেলেছেন ‘রেবেল’ ভাব আনতে গিয়ে। অতটা না করলেও হত মনে হয়। আর, তনুশ্রী’র এটা জানা উচিত ছিল যে কাঁচের দরজা, ভারি কোনো টেব্‌ল বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে ভেঙে ফেলা সম্ভব :/ এইসব সাধারণ জিনিস-ও যদি মানুষ শিখতে না পারে সিনেমা দেখে… tch tch।

তো যান, আজ সবে পঞ্চমী… গিয়ে দেখে আসুন। তবে, সিনিমা দেক্তে যাচ্চি, ক্কী বালো, ক্কী মজ্‌জা— এরকম মনোভাব নিয়ে না যাওয়াই ভাল। বরং, আমি সর্বহারা, আমার হারানোর আর কিছুই নাই–এরকম ভেবে যান, ভাল লাগবে। ইন্ট্যারভেলের পর, সামান্য ঘুম পেতে পারে, তখন পপকর্ন এবং কফি খান।

ডিসক্লেইমারঃ প্রায় প্রত্যেক বাঙালি তথা ভারতবাসীর মতন আমিও নেতাজীকে নিয়ে গর্বিত এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে, যদি নেতাজী থাকতেন, আমাদের ইতিহাস অন্যরকম হত। যা লেখা হয়েছে, তা শুধুমাত্র “গুমনামি” নামক ফিল্মের ভিত্তিতে।

সিজিদ্দা, #ভিঞ্চিদা এবং আমি

“দাদা”– এই শব্দবন্ধ নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতা চিরকালীন। মহারাজ জন্মানোর বহু আগে থেকেই বাঙালি দাদা জ্বরে আক্রান্ত। যেকোন কিছু বা যেকোন কারো পশ্চাৎদেশে একখানি “দা” লাগিয়েই বাঙালি বরাবর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এসেছে। যেমন, হাঁ-দা, ভোঁ-দা, না-দা, চো…. আচ্ছা ইয়ে, এটা থাক :/  এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলেন  সর্বজনপ্রিয় মদন্দা ❤ তো, এইরকম একটা মরশুমে #ভিঞ্চিদা মুক্তি পেলেন। পোস্টারে ভিট্রুদা’র ছাপ্পা মারা, ট্রেলার দেখে বেশিরভাগ পেটরোগা বাঙালি “উফ্‌! বাবা! ক্কী টেনশন! ক্কী থ্রিল রে দাদ্দা” বলে উঠেছে।

এমতাবস্থায়, শনিবারের পুণ্য বারবেলায় আমার দুই বন্ধু এবং আমি ঠিক করলাম একটা সিনেমা দেখলে হয় 🙂 আমার ইচ্ছে ছিল অন্য একটি ফিল্ম দেখার, যেটি “নন্দন”-এ চলছে। কিন্তু এক বন্ধু  নীল, লাল বা গেরুয়া কিছু’র একটা উপোস করেছে, সে বড় নাকি কাহিল, দুব্বল যাকে বলে  :/  অদ্দূর যাবে না। বাড়ি’র কাছে হাইল্যান্ড পার্কে সে #ভিঞ্চিদা দেখতে চায়। আমি যেহেতু উপোস করিনি, তাই আমি লেসার হিউম্যান বিয়িং এবং তার কথা-ই শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হল। অবশ্য, আমি ব্যাটাকে রসিয়ে রসিয়ে গপ্পো শুনিয়ে দিয়েছি সেদিন কী কী রান্না করেছি বাড়িতে (স্যাডিস্ট প্লেজার)।

“ভিঞ্চিদা” একটি থ্রিলার। ক্রিস্টি, ডয়েল বা নেসবোসুলভ Whodunnit থ্রিলার নয়। এখানে আপনি জানেন কে ক্রাইম করছে, কেন করছে, কীভাবে করছে। তাকে পুলিশ ধরতে পারে কি-না বা তার  জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় যে চরিত্রটি, তার সঙ্গে মানসিক টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হয়– এই উত্তেজনা এবং কৌতূহল দর্শক-কে বসিয়ে রাখে। খানিকটা হিগাসিনো টাইপ থ্রিলার।

রুদ্রনীল ঘোষ এখানে একজন মেকআপ আর্টিস্ট। সাধারণ নন, তাঁর অসাধারণত্ব হল, তিনি প্রস্থেটিক মেকআপ করতে পারেন অপরিসীম দক্ষতার সঙ্গে। কিন্তু টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁর প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ এবং তিনি-ও কাজ পাওয়ার জন্য কারো কাছে মাথা নোয়াবেন না বলে বদ্ধপরিকর। রুদ্রনীল’র মুখে বেশ কিছু চোখা ডায়ালগ আছে টালিগঞ্জ নিয়ে। সত্যবচন যারে কয় আর কী। রুদ্রনীল অভিনয় খারাপ করেন এমন কথা বোধহয় কেউ বলবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু অতি-নাটকীয়তা করে ফেলেন বা স্বাভাবিকত্বের অভিনয়টা সামান্য বেশি হয়ে যায়। এখানেও কিছু জায়গায় তাই হয়েছে। তবু, তাঁর (তিনিই ভিঞ্চিদা), ঋত্বিক চক্রবর্তী (আদি বোস) এবং  অনির্বাণ চক্রবর্তী (ডিসিডিডি পোদ্দার)-এর অভিনয় দর্শক-কে বাধ্য করে বসে থাকতে। বিশেষ করে ঋত্বিক-এর চরিত্র খুব অল্পক্ষণের জন্য হলেও, একটা subliminal anxiety তৈরি করে দর্শকের মনে, থ্রিলারের জন্য যেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা ফ্যাক্টর বলে আমার অন্ততঃ মনে হয়।

ভিঞ্চিদা’র চরিত্র হয়ত এ-দেশের অনেক নাম-না-জানা মেকআপ আর্টিস্টের জীবন। তাঁরা পয়সা কত পান আমি জানিনা, কিন্তু সম্মান খুব একটা যে পান না, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কয়েক বছর আগে, একবার শান্তিনিকেতন থেকে ফিরছিলাম। এমনিতে আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, যারা “শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের” এসি কামরায় ওঠে, তাদের বেশিরভাগের হাবভাব দেখলে মনে হয়, সদ্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গোলটেব্‌ল বৈঠক সেরে  ট্রেনে উঠেছে। এবং, কোনো এক অজানা কারণে, তারা ইংরিজিতে কথা বলে। (আপনি ভাবতেই পারেন আমি কেন উঠেছিলাম, সেক্ষেত্রে গামছা, ধোপাবাড়ি, কুঁজো, চিৎ হওয়া ইত্যাদি মনে করুন) তো, আমার পাশের ভদ্রলোক আচমকা ফোনে উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন,
— খব্বদ্দার তুই মেয়েটা’র চুলে-মুখে হাত দিবিনা। শুধু হাত কর আর পা…বাকি আমি বুঝে নেবো!

ফোন রেখে দেওয়া’র পর আমি সামান্য ভীতভাবে তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি মুচকি হেসে জানিয়েছিলেন তিনি একজন মেকআপম্যান। যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গে সাধারণ কিছু কথা হয়েছিল কিন্তু তার মধ্যেই নিজের প্রোফেশন  নিয়ে তাঁর ভালবাসা টের পেয়েছিলাম। এবং এটাও বুঝেছিলাম যে এই মানুষগুলোর পরিশ্রমের কথা আমরা কিছুই জানতে পারিনা। এদেশের বিখ্যাত মেকআপ (SFX) আর্টিস্ট সুভাষ শিন্ডে পর্যন্ত “মেরি কম” ফিল্ম নিয়ে একটা ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন সেখানে তাঁকে টক্কর দিতে হয়েছিল হলিউডের সঙ্গে কাজটা পাওয়ার জন্য।

এতখানি ডাইগ্রেস করা’র  কারণ একটাই। রুদ্রনীলের চরিত্রটি রিয়ালিস্টিক। কিন্তু ওই বাংলা সিনেমায় যা হয় আর কী 😦 একটু না ছড়ালে বদহজম হয় মনে হয়। তাই আমরা দেখি বেকার, দুখী, রাগী, মনমরা, বাপ-হারা, গরিব রুদ্রনীল পাড়ার নাটকে দুর্ধর্ষ মাস্ক-ফাস্ক বানিয়ে দিচ্ছে! ওসব বানাতে যা খরচ পড়বে তাতে বাচ্চাদের বাপ-মা কেলিয়ে লাট করে দেবে তবু নাটক করতে দেবেনা ছেলেমেয়েদের। তাছাড়া, ফরেন্সিক সায়েন্সকে তুশ্চু করা কিছু ব্যাপার-ও আছে। স্পয়লার হয়ে যাবে তাই বলা যাবেনা। তা, সেসব দশ-বিশটা লুপ্‌হোল্‌স ম্যাক্সিমাম থ্রিলারেই থাকে। সিজিদ্দা বলে-ই যে বেশি বেশি ভুল ধত্তে হবে তা তো না…হুঃ!

তাহলে কী দাঁড়াল? (কী, কি নয়) এই যে, #ভিঞ্চিদা হল নির্বাক রাজকাহিনী’র শাহজাহান রিজেন্সি-তে ইয়েতি অভিযানে’র পর যেন বাড়ির পুকুরে সানি লিওনের স্নান, যেন মাসের শেষে’র “ইয়োর অ্যাকাউন্ট হ্যাজ বিন ক্রেডিটেড উইদ”, যেন পয়লা বৈশাখের সকালে ফুলকো লুচি আর সাদা আলু’র তরকারি, যেন নিজের বরের মধ্যে ব্র্যাড পিটের ঝলক দেখা, যেন…… যাক্‌গে…দেখে আসুন গিয়ে। পয়লা বৈশাখ ভালই কাটবে 🙂

খুব চেনা ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমন হয়; স্বামী রিটায়ার করেছেন এক যুগ হয়ে গেছে, স্ত্রী বয়সে খুব বেশি ছোট নন স্বামী’র থেকে। অনেক, অনেক বছর আগে হলেও তাঁদের ছিল ভালবাসার বিয়ে।  দুজনকে-ই এখন “ওয়াকিং স্টিক”-এর ভরসায় হাঁটাচলা করতে হয়। কিন্তু, সেটা তাঁরা করেন না বেশিরভাগ সময়ে। একে-অপরকে আঁকড়ে ধরে পা টিপে টিপে রাস্তার এক পাশ দিয়ে সাবধানে হাঁটেন। স্ত্রী মাঝে মাঝে চকিতে দেখে নেন পেছন ফিরে, আচমকা কোনো কাণ্ডজ্ঞানহীন রিকশা বা অটো বেমক্কা উঠে এল নাকি গায়ের ওপর! স্বামী সেটা-ও আবার পারেন না, গলায় মোটা বেল্ট, স্পন্ডিলিসিস।

ছেলে-মেয়ে দুজনেই যথাক্রমে অন্য দেশে এবং প্রদেশে থাকে। ওনারা একাই আছেন এবং, দিব্যি আছেন।
হাজার অসুস্থতা, শারীরিক অসুবিধে এবং বহুবিধ অন্য নিত্যকার ঝামেলা সামলিয়ে-ও আমি ওনাদের হাসতে দেখি। সকলেই দ্যাখে। আমার মতন অবাক-ও হয় হয়তো। আমরা যেখানে এই বয়সেই “আর পারছিনা” লব্জ আওড়াতে থাকি পান থেকে চুন খসলেই, সেখানে ওঁরা এখন-ও হাসেন। ফরসা মুখে বলিরেখা উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে, চোখের কোণে অগুন্তি হাঁসের পায়ের ছাপ সোচ্চারে জানান দেয়, এ হাসি অনেক পুরনো।

বেশ কিছুদিন আগে, পাড়া’র ওষুধের দোকানে গেছি মা’র ওষুধ কিনতে। সেদিন কোন কারণে কর্মচারী খুব কম। ব্যস্ততা’র শেষ নেই। মাসের প্রথমে যেকোন ওষুধের দোকানে আজকাল গেলে দেখা যায়, বয়স্ক এবং নট-সো-বয়স্ক মানুষরা মাসকাবারী বাজার করা’র মত ওষুধ কিনছেন 😦 আমার সামনেই একজনের বিল হল প্রায় সাত হাজার টাকা’র কাছাকাছি। সারা মাসের ওষুধ। তো যাইহোক, আমি ওষুধ নিয়ে বেরোতে যাবো, এমন সময়ে দোকানদার কাকু একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন “ওমুক বাড়িতে এই ক’টা ওষুধ দিয়ে দিবি একটু যাওয়ার সময়? তোদের পাড়াতেই, চিনিস মনে হয়। আজ একটাও লোক নেই যে পৌঁছে দেবে। এদিকে বয়স্ক মানুষের জিনিস, না দিলেই নয়”। না করা’র কারণ নেই। এই দোকানদার কাকু আমায় ছোটবেলা থেকে চেনেন। আর বাড়িটা বুঝলাম, যে বৃদ্ধ দম্পতি-কে মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখি, চোখাচোখি হয়, সামান্য হাসি কখনো, তাঁদের।

সেই প্রথম তাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা হল। দুজনেই ঝুলোঝুলি করতে লাগলেন ভেতরে ঢুকে চা খাওয়ার জন্য। অন্যদিন আসবো প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ফিরে এলাম।

তারপর গেছি বার দুয়েক।

কয়েকদিন আগে গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক প্রায় শয্যাশায়ী। কোনোভাবে ভীষণ ঠাণ্ডা লাগিয়েছেন। কথাই বেরোচ্ছেনা গলা দিয়ে। তাও, আমি যেতেই ইশারা করে বোঝালেন স্ত্রী-কে, চা করো। আমি যত বলি খাবোনা, তিনি তত-ই ইশারা করে এক-ই কথা বলেন। মাসিমা স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বললেন, “তুমি ভেবোনা আর। তোমায় খেতেই হবে, নইলে ইনি এই দশ মিনিট আগে চা খেয়েই আবার খাবেন কী করে!”
ধরা পড়ে মুখ গোঁজ করে স্ত্রী-কে কাঁচকলা দেখালেন। এবার আমি আগে হাসলাম।

টুকটাক কথা হচ্ছিল। হাসতে হাসতেই হঠাৎ মাসিমা বললেন। “জানো তো, আমি সবসময় ঠাকুরকে বলি এই মানুষটা যেন আগে রওনা দেয়। আমি আগে গেলে  খুব কষ্ট হবে ওর।”

কাঠ হয়ে গেলাম শুনে। কতখানি ভালবাসলে এরকম বলা যায়! আমরা তো সবসময়েই বলি, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না– এই বাক্যটি-ই নাকি শ্রেষ্ঠ প্রেমের উক্তি। অথচ, তার মধ্যে মিশে থাকে এক অপরিসীম স্বার্থপরতা। সেখানেও আমরা চিন্তা করি নিজের সুখটুকু, ভালবাসার মানুষটি না থাকলে দিনযাপন ভয়ানক হয়ে ওঠে, বিশেষতঃ বার্ধক্যে। আমরা ভাবি, সেই সীমাহীন শূন্যতা আমায় অন্ততঃ যেন ভোগ করতে না হয়, অন্ধকারের স্মৃতি হাতড়ে, অশক্ত টলমল পায়ে, আমি যেন অন্ততঃ জীবনের কাছে মুক্তি ভিক্ষা না করি। সঙ্গী বা সঙ্গিনী’র যা হয় হোক, আমায় যেন নিংড়ে-নেওয়া মানসিক যন্ত্রণা না পেতে হয়। হয়ত বা অতিরঞ্জত ভাবনা, কিন্তু এরকম-ই মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তে।

এরকম-ও ভালবাসা হয়। এরকম-ও ভালবাসা যায়।